মায়ের ভাষায় কথা বলার কারণে ভারতে বিপদে আছেন বাংলাভাষীরা। বিগত চার মাসে তিনটি রাজ্যে প্রায় ৯ হাজার বাংলাভাষীকে ধরে অস্থায়ী বন্দিশালায় আটকে রাখা হয়েছে। দুই হাজার বাংলাভাষীকে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়েছে ভারতের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পরিস্থিতি এতটা বেগতিক যে মানুষ বাংলায় কথা বলতে ভয় পাচ্ছে। গেল শুক্রবার নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।
গেল ২২ এপ্রিল কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলা হয়। হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করেছে ভারত। অভিযোগ উঠেছে, এই ইস্যুতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ভয় ছড়ানোর হাতিয়ার বানিয়েছে ভারত সরকার। শুরু করে ভারতে অভিবাসন বিরোধী অভিযান। বিশেষ লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে বাংলায় কথা বলা মানুষজনকে। জানাগেছে, অভিবাসন বিরোধে অভিযানে আটকদের অধিকাংশ মানুষ কখনও পাকিস্তানে যাননি।
বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার সরকারি ভাষা বাংলা। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের দুই পাশে কোটি কোটি মানুষ বাংলায় কথা বলে। যে কয়েক হাজার ভারতীয় বাংলাভাষীকে আটক বা বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে তাদের বেশির ভাগই মুসলমান। অনেকে পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা। কয়েক দশক ধরে পশ্চিমবঙ্গের তরুণরা জীবিকার তাগিদে ভারতের অন্যান্য বড় শহরে যাচ্ছেন।
অভিযোগ রয়েছে, কয়েক লাখ অবৈধ বাংলাদেশি ভারতে বসবাস করেন। সীমান্ত পথে তারা বৈধ বা অবৈধভাবে যাতায়াত করেন। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বাংলাভাষী মানুষের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোতে অভিযান চালিয়ে অনিবন্ধিত অভিবাসী থাকার প্রমাণও পাওয়া গেছে।
গেল জুলাই মাসে রাজধানীর নয়াদিল্লির উপশহর গুরুগ্রাম কর্তৃপক্ষ অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। স্থানীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, গুরুগ্রাম পুলিশ এমন কয়েকশ মানুষকে আটক করেছে, যাদের অনেকেরই ভারতে বসবাসের অনুমোদন আছে। পরে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এই অভিযান শুরুর পর কয়েকশ গরিব বাংলাভাষী মানুষ পুলিশি হয়রানির ভয়ে শহর ছেড়ে পালিয়ে গেছে।
গুরুগ্রাম পুলিশের জনসংযোগ কর্মকর্তা সন্দীপ কুমার জানিয়েছেন, শহর ছেড়ে পালানোর খবরটি গুজব। এই অভিযানে দুই থেকে আড়াইশ জনকে আটক করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ১০ জন অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসী হিসেবে সনাক্ত করা হয়েছে।
গুরুগ্রামে আটক-সংক্রান্ত মামলা নিয়ে কাজ করেন আইনজীবী সুপান্থ সিনহা। তিনি বলেছেন, প্রায় এক হাজার মানুষ শহর ছেড়ে পালিয়েছেন। অভিযান চালানো চারটি রাজ্যের বেশকিছু মুসলিম ও হিন্দু বাংলাভাষী জানিয়েছেন, তারা অভিযানের ভয়ে আছেন।
গুরুগ্রামে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ করেন অভিজিৎ পাল (১৮) নামে একজন। তিনি পশ্চিমবঙ্গ থেকে সেখানে গিয়েছিলেন। তাঁর বস্তিতে অভিযানের সময় তিনি পুলিশকে পরিচয়পত্র দেখান। তারপরও তাঁকে পাঁচ দিন আটকে রাখা হয়। তাঁর ভারতীয় নাগরিকত্বের পক্ষে সমাজকর্মীরা পুলিশকে অতিরিক্ত নথি দেখানোর পর তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে আবারো গ্রেফতার হওয়ার ভয়ে তিনি গুরুগ্রাম ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে ফিরে গেছেন। এখন বেকার। তিনি জানান, আবার ধরা পড়ার ভয়ে আছেন। কারণ তিনি বাংলায় কথা বলেন।
সাইফ হাসনাত ও প্রণব ভাস্করের লেখা নিউইয়র্ক টাইমসের ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, কয়েক লাখ ভারতীয় আছেন। যাদের নাগরিকত্ব প্রমাণের কাগজ-পত্র নেই। মানবাধিকার গোষ্ঠী ও আইনজীবীদের অভিযোগ, বিচারিক প্রক্রিয়া অনুসরণ না করেই সরকার এই অভিযান চালাচ্ছে। ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) গেল এপ্রিল মাসে সন্ত্রাসী হামলাকে ভারতের মুসলমানদের ওপর নিপীড়নের হাতিয়ার করে তুলেছে।
এ হামলার পর থেকে বিজেপি নেতৃত্বাধীন ভারতীয় রাজ্যগুলোতে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা বা বাংলাদেশি মুসলমানকে গ্রেফতার কিংবা আটক করা হয়েছে।
রাজ্য পুলিশ জানিয়েছে, গুজরাটে সাড়ে ৬ হাজার কাশ্মীরে ২ হাজার এবং রাজস্থানে প্রায় আড়াই’শ জনকে আটক করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের আটক রাখতে মে মাসে রাজস্থানে তিনটি অস্থায়ী বন্দিশালা স্থাপন করা হয়েছে।
ভারত থেকে বাংলাদেশে বহিষ্কৃত মানুষের প্রকৃত সংখ্যা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বলেছেন, মে থেকে জুলাই পর্যন্ত ভারত থেকে প্রায় দুই হাজার মানুষকে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
জুলাই মাসে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে পারায় কয়েক ডজন মানুষকে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে ভারত। সংস্থার এশিয়া বিষয়ক উপ-পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলী বলেছেন, মূলত দরিদ্র মুসলিম অভিবাসী শ্রমিকদের এই অভিযানের লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে ।
পশ্চিমবঙ্গ থেকে রাজস্থানে নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে গিয়েছিলেন আমির শেখ (২১) নামে এক যুবক। তাঁর চাচা আজমাউল শেখ বলেছেন, তার ভাতিজার পরিচয়পত্র এবং জন্ম সনদ আছে। তারপওর গেল জুন মাসে পুলিশ তার ভাতিজাকে গ্রেফতার করে। তিন দিন পুলিশ হেফাজতে থাকার পর পরিবারের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
পশ্চিমবঙ্গে জন্ম নেওয়া পরিচ্ছন্নতাকর্মী ডেনিশ শেখকে (২৭)। গেল জুন মাসের শেষ দিকে প্রসূতি স্ত্রী ও ছেলেসহ (৮) তাকে আটক করা হয়। তিনি জানিয়েছেন, ভারতে তাদের পরিবারের কয়েক দশকের পুরোনো জমির নথি এবং ভারতীয় পরিচয়পত্র আছে। তারপরও পাঁচ দিন পুলিশ তাদেরকে আটকে রেখে রেখে জঙ্গলে ছেড়ে দেয়। হেঁটে বাংলাদেশে যেতে বলে।
গুজরাটের ইমরান হোসেন (৬০) নামে এক ব্যাক্তির বাড়িতে অভিযান চালায় ভারতীয় পুলিশ। তাকে চোখে পট্টি বেঁধে মারধর করে। পাঁচ দিন নৌকাযাত্রার পর তাঁকে বাংলাদেশে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি বলেছেন, এখনো রাতে ঘুমাতে কষ্ট পান। ঘুমানোর চেষ্টা করলে, মানুষের কান্নার শব্দ শুনতে পান।
দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশকে ‘অনুপ্রবেশকারীদের কেন্দ্র হিসেবে বর্ণনা করছেন বিজেপি নেতারা। এটি ভারতের বহু ধর্ম-ভাষা-জাতি পরিচয়কে হুমকিতে ফেলছে। আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা জুলাইয়ে এক্স-এ পোস্ট করে ‘জনসংখ্যার এক উদ্বেগজনক পরিবর্তন’ সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেছেন, তাঁর রাজ্য ‘সীমান্ত পেরিয়ে মুসলিম অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ’ গড়ে তুলেছে।
আসামে তিনভাগের প্রায় একভাগ মানুষ মুসলমান। বাংলাভাষী পরিচয় সেখানকার অনেক পুরোনো সমস্যা। রাজ্যের সবশেষ বহিষ্কার অভিযানে হিমন্ত শর্মা ১৯৫০ সালের আইনের কথা উল্লেখ করেন। ওই আইনেই বিচার ব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে সন্দেহভাজন অবৈধ অভিবাসীদের বহিষ্কার করা হচ্ছে।
আসামে নাগরিকত্ব নিয়ে চলা মামলা নিয়ে গবেষণা করেন মহসিন ভাট নামে একজন আইনজীবী। তিনি মনে করেন ‘এটা একেবারে ভয়ংকর।’
আসামে বসবাসকারী চাষি মালেক অস্টার। তাঁর মাকে গেল জুনের প্রথম দিকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। মায়ের অবস্থান সম্পর্কে তাঁকে কিছু জানানো হয়নি। তিনি বলেছেন, ‘তার মায়ের ভোটার কার্ড, আধার কার্ড ও রেশন কার্ড আছে। কিন্তু পুলিশ সেগুলো গ্রহণ করেনি। কেন করেনি, জানেন না।’
তিনি আরও জানান, তাঁর পরিবার কখনো বাংলাদেশে যায়নি। অভিযানের কারণে বাইরে গেলে বাংলায় কথা বলতে ভয় পান। বর্তমানে অন্যান্য বাংলাভাষীর মতো তিনিও নিজেকে বহিরাগত মনে করছেন।