রাজধানী

মোহাম্মদপুরে মা-মেয়ে হত্যা

আয়েশাকে ধরার শ্বাসরুদ্ধকর ৬০ ঘণ্টার বর্ণনা

বায়ান্ন প্রতিবেদন

ছবি: সংগৃহীত

কোনো স্পষ্ট ক্লু না থাকলেও মাত্র ৬০ ঘণ্টায় শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানে মোহাম্মদপুরের মা–মেয়ে হত্যার রহস্য ভেঙে ফেলেছে পুলিশ। শাহজাহান রোডে গৃহকর্মীর হাতে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর তদন্ত ছিল পুরোপুরি ‘ক্লুলেস’—কোনো ছবি নেই, নেই মোবাইল নম্বর, নেই পরিচয়পত্র। তবু তেজগাঁও বিভাগের টিম পূর্বের চুরির তথ্য আর একটি পুরনো মোবাইল নম্বরের সূত্র ধরে শেষ পর্যন্ত শনাক্ত করে মূল আসামি আয়েশাকে। এরপর স্বামীসহ তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

পুলিশ জানিয়েছে, মোহাম্মদপুর থানার অতীতের বিভিন্ন মামলা ও জিডির তথ্য বিশ্লেষণ করে আয়েশাকে শনাক্ত করা হয়। পরে ম্যানুয়াল সোর্স ও তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। 

বৃহস্পতিবার (১১ ডিসেম্বর) দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স) এস এন মো. নজরুল ইসলাম প্রেস ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান।

তিনি জানান, গত ৮ ডিসেম্বর সকাল ৭টা ৫১ মিনিট থেকে ৯টা ৩৫ মিনিটের ভেতরে মোহাম্মদপুরের শাহজাহান রোডে লায়লা আফরোজ (৪৮) ও তার মেয়ে নাফিসা লাওয়াল বিনতে আজিজ (১৫) ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। এই ঘটনায় ৩ দিন আগে কাজে যোগ দেওয়া গৃহকর্মী ‘আয়েশা’কে দায়ী করে মামলা করেন নিহতের স্বামী আজিজুল ইসলাম (৫৭)।

এই ঘটনায় আয়েশাকে সন্দেহ করা হলেও বড় চ্যালেঞ্জ ছিল গৃহকর্মী আয়েশার কোনো ছবি, এনআইডি, মোবাইল নম্বর বা পরিচয় সংরক্ষিত না থাকা। সিসিটিভির ফুটেজেও তাকে চেনার মতো কোনো স্পষ্ট ভিজ্যুয়াল পাওয়া যায়নি, কারণ সে প্রতিবারই বোরকা পরে, মুখ ঢেকে আসা যাওয়া করতো।

নজরুল ইসলাম জানান, ঘটনার আশেপাশে কোনো ডিজিটাল ক্লু না পেয়ে তদন্ত দল ‘ম্যানুয়াল’ উপায়ে থানায় গত এক বছরের গৃহকর্মী কর্তৃক সংঘটিত চুরির ঘটনাগুলো খুঁজতে থাকে। তদন্তকারীরা বিশেষভাবে লক্ষ্য করেন গলায় পোড়া দাগ, জেনেভা ক্যাম্প এলাকায় বাস, গৃহকর্মীর পরিচয়ে সংঘটিত পূর্বের চুরি তথ্য নিয়ে মাঠে নামে তদন্তকারীরা। এখানে আয়েশার তথ্য মিলে যায়। হুমায়ুন রোডে  ভুক্তভোগী পরিবার থেকে একটি পুরনো মোবাইল নম্বর পাওয়া যায়, যা থেকেই শুরু হয় আসামির সন্ধান। ওই নম্বরে যোগাযোগ করলে জানা যায় তার মোবাইল নম্বরটি কখন কে ব্যবহার করেছেন তিনি সঠিক মনে করতে পারছেন না। তবে কিছুদিন পূর্বে তার ফোনে ডিসপ্লে নষ্ট থাকায় রাব্বী নামে তার এক ছোট ভাইকে ঠিক করার জন্য দেন এবং এই সময় সিমটি রাব্বীর ফোনে ব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে।

সিডিআরের বিশ্লেষণে পাওয়া অবস্থান ধরে হেমায়েতপুরে গিয়ে জানা যায় নম্বরটি ব্যবহার করত রাব্বি নামের এক ব্যক্তি। তদন্তে বেরিয়ে আসে রাব্বির স্ত্রীই হলো সেই আয়েশা। আরও জানা যায়, তারা জেনেভা ক্যাম্পে ভাড়া বাসায় থাকে। এভাবে ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হত্যাকারী আয়েশার পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়।

নজরুল ইসলাম বলেন, আয়েশাকে গ্রেপ্তার করার জন্য পুলিশ প্রথমে হেমায়েতপুরে তার মায়ের বাসায় অভিযান পরিচালনা করে। কিন্তু তার মা জানান তারা রাতে বাসায় ছিল, সকাল বেলা বের হয়ে গেছে। আয়েশার মা‘কে নিয়ে পুলিশ রাব্বির মায়ের বাসায়ও যায়, কিন্তু সেখানেও তাদের পাওয়া যায়নি। তারা পুলিশকে জানায় আয়শা ও রাব্বি বরিশালে গিয়ে থাকতে পারে। এক পর্যায়ে তাদের কাছে প্রাপ্ত তথ্য ও প্রযুক্তির সহায়তায় পটুয়াখালীর দুমকি থানাধীন প্রত্যন্ত নলুয়া এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে পুলিশ। কিন্তু সেখানেও তাদের পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে এডিসি মোহাম্মদপুরের নেতৃত্বে থাকা পুলিশের আভিযানিক টিম ঝালকাঠি জেলার নলছিটি থানার চরকারা গ্রামে আয়েশার স্বামী রাব্বীর দাদার বাড়িতে বুধবার (১০ ডিসেম্বর) অভিযান পরিচালনা করে দুপুরে আয়েশা ও তার স্বামী জামাল সিকদার রাব্বীকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তাদের কক্ষ তল্লাশী করে গৃহকর্মী আয়েশা কর্তৃক চোরাইকৃত একটি ল্যাপটপ উদ্ধার করা হয়। 

তিনি বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আয়েশা ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছে। একইভাবে জানা যায় গৃহকর্মে নিয়োজিত থেকে চুরি করার অভ্যাস তার আগে থেকেই ছিলো। 

পুলিশের এই কর্মকর্তা জানান, চাঞ্চল্যকর এই জোড়া খুনের কারণ অনুসন্ধানে আয়েশা বলে, কাজে আসার দ্বিতীয় দিনে সে বাসা থেকে দুই হাজার টাকা চুরি করে।  তৃতীয় দিন টাকার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদের সময় গৃহকর্ত্রীর সঙ্গে তার তর্কাতর্কি হয়। এ সময় লায়লা আফরোজ আয়েশাকে পুলিশে দেয়ারও ভয় দেখান। চতুর্থ  দিন কাজে আসার সময় আয়েশা বাসা থেকে একটা সুইচ গিয়ার চাকু নিয়ে আসে। ঘটনার দিন টাকা চুরি নিয়ে তাদের মধ্যে আবারও কথা কাটাকাটি হয়। পরবর্তীতে বিষয়টি আফরোজা ফোনে তার স্বামীকে কল দেয়ার চেষ্টা করলে পেছন থেকে ছুরি মারে আয়েশা। এই সময়ে ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে তাকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাতে হত্যা করে ঘাতক গৃহকর্মী। এ সময়ে মায়ের চিৎকার শুনে ঘুম থেকে ওঠা নাফিসা তার মাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসলে তাকেও ছুরিকাঘাত করে। নাফিসা ইন্টারকমে গার্ডকে ফোন দিতে চাইলে আয়েশা ইন্টারকমের মূল তার ছিঁড়ে ফেলে। আয়েশার ছুরিকাঘাতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে দুজনেরই মৃত্যু হয়।

ডিএমপির এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ঘটনার সময় আয়েশা নিজেও আহত হয় এবং রক্তমাখা কাপড়চোপড় পাল্টে গোসল করে নাফিসার স্কুল ড্রেস পরে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। যাওয়ার সময় ব্যাকপ্যাকে একটি ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন ও আরও কিছু জিনিসপত্র নিয়ে যায়। বাসা থেকে বের হয়ে সে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলের ভিতরে গিয়ে পুনরায় কাপড় পাল্টে সাভারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। পরবর্তীতে  ঢাকা ছাড়ার সময়ে সে চুরি করা ফোন ও রক্তাক্ত কাপড়চোপড় সিংগাইর ব্রিজ থেকে নদীতে ফেলে দেয়।

এক প্রশ্নের জবাবে অতিরিক্ত কমিশনার নজরুল বলেন, আয়েশা আগে থেকেই চুরির স্বভাব রয়েছে। এমনকি নিজের বোনের বাড়ি থেকেও ২ লাখ টাকা ও ৪ ভরি স্বর্ণালংকার চুরি করেছিল। এর আগে হুমায়ুন রোডে চুরির ঘটনায় থানা পুলিশ তাকে আটক করেছিলো। 

ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারের ব্রিফিং’এ উপস্থিত ছিলেন, তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার(ডিসি) মোহাম্মদ ইবনে মিজান, মোহাম্মদপুর জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার(এসি) আব্দুল্লাহ আল মামুন, মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো মেজবাহ উদ্দিন, এসআই পরিদর্শক (তদন্ত) রকিব উজ্জামান, এসআই আক্কেল আলী ও মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা শহিদুল ওসমান মাসুম।

 

এসি//

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন #ডিএমপি #মোহাম্মদপুর #মা-মেয়ে #গৃহকর্মী আয়েশা #হত্যা