হঠাৎ দুলে ওঠা ঘর থেমে গেলেও- মনে হয় শরীর যেন এখনো দুলছে। চারপাশ স্থির, কিন্তু ভেতরে অদৃশ্য দোলাচল। ভূমিকম্প থেমে যাওয়ার পর এই অস্বস্তিকর অনুভূতি অনেকেরই পরিচিত। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এর নাম—‘আর্থকোয়েক সোয়ে সিনড্রোম’, যেখানে শরীরের ভারসাম্য–নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থাই সাময়িকভাবে দিশেহারা হয়ে পড়ে।
ভূমিকম্পের আকস্মিক ঝাঁকুনিতে কানের গভীরে থাকা ভেস্টিবুলার সিস্টেম যেন মুহূর্তের জন্য তাল হারিয়ে ফেলে। তাই কম্পন থেমে যাওয়ার পরও মাথা ঘোরা, হালকা দুলুনি বা ভারসাম্য হারানোর মতো অনুভূতি হওয়াটা একেবারেই স্বাভাবিক। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কয়েক মিনিটেই এই সমস্যা মিলিয়ে যায়, কারও ক্ষেত্রে তা কয়েক ঘণ্টাও স্থায়ী হতে পারে।
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন- এই অস্বস্তি যদি ২৪ ঘণ্টা পার হওয়ার পরও না সারে, তাহলে বিষয়টি হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। তখন তা অন্য কোনো স্নায়বিক বা স্বাস্থ্যগত সমস্যার ইঙ্গিত হতে পারে।
চিকিৎসা গবেষণায় দেখা গেছে, ভূমিকম্পের সময়ের হঠাৎ দোলায় কানের ভেতরের ‘ব্যালান্স সেন্টার’ অস্থিতিশীল হয় বলে এই সমস্যা তৈরি হয়। প্রথম কয়েক ঘণ্টা তাই মাথা ঘোরা বা দুলুনি পুরোপুরি স্বাভাবিক—কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী হলে বিশেষজ্ঞরা দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন।
যে সব কারণে ২৪ ঘণ্টার বেশি মাথা ঘুরতে পারে-
১. ভেস্টিবুলার ডিসঅর্ডার
আগে থেকে কানের ভেতরের ভারসাম্যব্যবস্থা দুর্বল থাকলে ভূমিকম্পের নড়াচড়ায় সমস্যা বেড়ে যেতে পারে। এতে দীর্ঘ মাথা ঘোরা, দুলুনি, অস্পষ্ট দৃষ্টি ইত্যাদি দেখা দেয়।
২. বেনাইন পজিশনাল ভার্টিগো (বিপিপিভি)
ভেস্টিবুলার সমস্যায় আক্রান্তদের মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ সমস্যা। কানের ক্ষুদ্র ক্যালসিয়াম কণা স্থানচ্যুত হলে মাথা বারবার ঘুরতে পারে। হালকা নড়াচড়াও অনেক সময় এই সমস্যা ট্রিগার করে।
৩. ভেস্টিবুলার মাইগ্রেন
মাথাব্যথা ছাড়াই শুধুমাত্র মাথা ঘোরা দিয়ে মাইগ্রেন প্রকাশ পেতে পারে। ভূমিকম্পের ভয় বা মানসিক চাপ এতে ভূমিকা রাখতে পারে।
৪. পোস্ট-ট্রম্যাটিক ভেস্টিবুলার সিনড্রোম
তীব্র ভয় ও মানসিক চাপ স্নায়ুতন্ত্রকে দীর্ঘ সময় অস্থিতিশীল রাখে। ফলে বারবার মাথা ঘোরা বা ভারসাম্যহীনতার মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
৫. পানিশূন্যতা, রক্তচাপ বা রক্তে শর্করা কমে যাওয়া
ভয় বা আতঙ্কে অনেকের রক্তচাপ বা গ্লুকোজ হঠাৎ কমে যেতে পারে, যার ফলে মাথা ঘোরা দেখা দেয়।
৬. ভূমিকম্প পরবর্তী স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PESD)
তীব্র ভূমিকম্পের পর অনেকের মানসিক অবস্থা দীর্ঘ সময় অস্থিতিশীল থাকে। এতে দেখা দিতে পারে—
অতীত স্মৃতি বারবার ফিরে আসা
.অকারণে আতঙ্ক
.ঘুমের সমস্যা
.হঠাৎ মাথা ঘোরা বা দুলুনি
গবেষণায় দেখা গেছে, পিইএসডি আক্রান্ত ব্যক্তিদের স্নায়ুতন্ত্র দীর্ঘ সময় ‘হাই অ্যালার্ট’ অবস্থায় থাকে, যার ফলে মাথা ঘোরা বা ভারসাম্যহীনতার মতো শারীরিক উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
ভূমিকম্পের পর মাথা ঘোরা ২৪ ঘণ্টার বেশি স্থায়ী হলে চিকিৎসকদের মতে, দীর্ঘস্থায়ী মাথা ঘোরা শুধু আতঙ্কের প্রতিফলন নয়; বরং এর পেছনে থাকতে পারে ভেস্টিবুলার সিস্টেমের গোলমাল, মাইগ্রেন–সম্পর্কিত ব্যাধি, কিংবা অতিরিক্ত স্ট্রেস ও মানসিক চাপের জটিলতা। তাই ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার পরও যদি মাথা ভার লাগা, দুলুনি বা ভারসাম্যহীনতা ঠিক না হয়, তাহলে দ্রুত বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।