আমাদের শৈশবের স্মৃতি, মা-বাবার আচরণ, এবং পরিবারের মধ্যে প্রাপ্ত ভালোবাসা- এসব বিষয় আমাদের জীবনের গভীরে ছাপ রেখে যায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই সম্পর্কগুলো কি আসলেই দূরে সরে যায়? বিশেষজ্ঞরা বলেন, শারীরিকভাবে হয়তো দূরত্ব তৈরি হয়, কিন্তু যে পরিবারে আমরা বেড়ে উঠি, তার প্রভাব আমরা চিরকাল অনুভব করি। আমাদের মনোভাব, সিদ্ধান্ত, এবং অনুভূতির ভিত্তি অনেকটাই ওই প্রথম প্রজন্মের শিক্ষা এবং অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে।
‘গুড এনাফ’ মা-বাবার ধারণা’ একটি বিপ্লব
১৯৫৩ সালে ইংরেজ শিশুরোগ ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডোনাল্ড উড উইনিকট প্রথমবারের মতো শিশুদের ভালো মায়ের ধারণা উন্মোচন করেন। তাঁর বিখ্যাত বই প্লেয়িং অ্যান্ড রিয়্যালিটি-তে তিনি বলেছিলেন, নিখুঁত মা-বাবার প্রয়োজন নেই, বরং এমন মা-বাবা দরকার, যারা সন্তানের প্রয়োজনের সময় সাড়া দেয়। তাঁর গবেষণার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালে লি হাই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুজান উডহাউজের গবেষণা থেকে জানা যায়, যদি মা-বাবা সন্তানের প্রতি ৫০% সময় সঠিকভাবে সাড়া দেন, তবে তাদের ‘গুড এনাফ’ মা-বাবা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
‘শৈশবের ইমোশনাল অবহেলা’এক অদৃশ্য যন্ত্রণা
মা-বাবা যখন সন্তানের অনুভূতি ও আবেগকে অবহেলা করেন, তখন তাকে বলা হয় ইমোশনাল অবহেলা। এই পরিস্থিতি তৈরি হয় যখন:
সন্তানের অনুভূতিকে অগ্রাহ্য করা হয়।
সন্তান কি অনুভব করছে, তা জানার চেষ্টা করা হয় না।
ইমোশনাল মুহূর্তে সন্তানের পাশে না থাকা।
অধিকাংশ মা-বাবা জানেন না যে তারা আসলে সন্তানকে ইমোশনালি অবহেলা করছেন। তারা হয়তো ভালো খাবার, সুন্দর পোশাক, এবং খেলাধুলার সুযোগ দিচ্ছেন, কিন্তু সন্তানের অনুভূতি বা আবেগের চাহিদা পূরণের চেষ্টা কম। এই পরিবারগুলোর বাইরে থেকে সহজে বোঝা যায় না, কারণ তারা শারীরিকভাবে কিছু অসন্তুষ্টি তৈরি না করলেও, আবেগের জায়গায় বড় এক শূন্যতা সৃষ্টি হয়।

কেন এই অবহেলা বোঝা যায় না?
ইমোশনাল অবহেলা শারীরিক নির্যাতন বা অবহেলার মতো সরাসরি দৃশ্যমান নয়। তাই শিশু যখন এই অভিজ্ঞতার মধ্যে বেড়ে ওঠে, প্রাপ্তবয়স্ক বয়সে এসে অনেকেই নিজেদের মধ্যে কিছু একটা ভুল অনুভব করেন, কিন্তু তা কী, তা বুঝে উঠতে পারেন না। পরিবারে থাকতে একধরনের অস্বস্তি অনুভব হয়, যার ফলে বিষণ্নতা সৃষ্টি হতে পারে।
পরিবারে ইমোশনাল অবহেলার ৮টি লক্ষণ
অনেক সময় আমরা বুঝতে পারি না যে পরিবারে ইমোশনাল অবহেলা হচ্ছে কি না, কারণ এটি সূক্ষ্ম এবং মনের গভীরে চলে যায়। তবে কিছু লক্ষণ দেখলেই আপনি বুঝতে পারবেন:
পরিবারের সদস্যদের কথাবার্তা বা যোগাযোগ হয় খুবই ভাসা ভাসা, গভীর নয়। আবেগ, সমস্যা বা কষ্টের বিষয়গুলোয় গভীরভাবে কথা হয় না।
কখনো কখনো মা-বাবার প্রতি অকারণ রাগ হয় বা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এটা নিয়ে অপরাধবোধও কাজ করে।
পারিবারিক অনুষ্ঠানে গিয়ে হতাশ বোধ করেন।
পরিবারের কঠিন সমস্যাগুলো এড়িয়ে যান। সরাসরি আলোচনা করা হয় না।
ভাইবোনদের মধ্যে একধরনের প্রতিযোগিতা থাকে, কারণটা কেউই ঠিক জানেন না।
আদর-ভালোবাসা প্রকাশ করেন কাজের মাধ্যমে, কথায় বা আবেগের মাধ্যমে নয়।
বিশেষ করে নেতিবাচক আবেগ, পরিবারে ‘বেআইনি’ মনে হয়।
পরিবারের মধ্যে থেকেও মাঝেমধ্যে একাকিত্ব বা বিচ্ছিন্নতা অনুভব করেন।
আপনি কী করতে পারেন?
আপনি পরিবারকে বদলাতে পারবেন না, তবে নিজেকে বদলাতে পারেন। এই লক্ষণগুলির মধ্যে যদি কিছু আপনার পরিবারের সঙ্গে মিলে যায়, তাহলে আপনি সেই আচরণগুলো পাল্টাতে শুরু করতে পারেন:
আপনার অনুভূতিগুলোকে দোষ হিসেবে দেখবেন না।
পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে অর্থপূর্ণ ও গভীর কথাবার্তা বলুন।
কঠিন বিষয়গুলো নিয়ে সরাসরি আলোচনা করুন।
কথার মাধ্যমে ভালোবাসা প্রকাশ করুন।
নেতিবাচক অনুভূতিগুলো মুখোমুখি হোন এবং সেগুলোকে অগ্রাহ্য না করে, সঠিকভাবে মোকাবেলা করুন।
বয়স বাড়লে সম্পর্কের মধ্যে শারীরিক দূরত্ব তৈরি হতে পারে, কিন্তু আবেগের দূরত্ব কাটানোর জন্য আপনার প্রতিদিনের চেষ্টা, কথাবার্তা, এবং অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনই আসল। পরিবার থেকে পাওয়া ভালোবাসা, যত্ন এবং অনুভূতির গুরুত্ব চিরকাল থাকে, এবং আমরা যদি সেই পরিবর্তনগুলো নিজের মধ্যে আনতে পারি, তবে আমাদের সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হবে।
সূত্র: হেলথ লাইন
এসি//