গাঁটছড়া বাঁধার মুহূর্তে আমরা স্বপ্নে ভরা চোখে একে অপরের দিকে তাকাই। প্রেমের উন্মাদনা, বিশ্বাসের বন্ধন আর ভবিষ্যতের হাজারো স্বপ্ন নিয়ে শুরু করি নতুন জীবন। কিন্তু অনেক সময় এই সুতা এতই পাতলা যে মাস না ঘুরতেই ছিঁড়ে যায় সম্পর্ক। ভাঙন, বিচ্ছেদ আর ক্ষয়ক্ষতির গল্পে ঢাকা থাকে আমাদের চারপাশ।
তবুও এমনও সম্পর্ক আছে যা সময়ের ঝড়ঝাপটা, অচিন্তিত সংঘাত আর প্রতিকূলতার মধ্যেও অটল থেকে যায়। একসঙ্গে বয়সের পর্দা পার করে বুড়ো হয় এমন দম্পতিদের কাছে আমাদের চোখ পড়ে। প্রশ্ন জাগে—দীর্ঘস্থায়ী দাম্পত্যের গোপন সূত্র কি? কোনো অদৃশ্য রহস্য কি আছে, যা গড়ে তোলে এমন টেকসই সম্পর্ক?
এই প্রশ্নের সবচেয়ে স্পষ্ট ও যথার্থ উত্তর মিলতে পারে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী দাম্পত্য জীবন কাটানো দম্পতি এলেনর গিটেনস ও লাইল গিটেনসের কাছে।
এলেনর গিটেনসের বয়স এখন ১০৭ বছর এবং তার স্বামী লাইল গিটেনসের বয়স ১০৮ বছর। যুক্তরাষ্ট্রের মায়ামি অঙ্গরাজ্যের এই জুটি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন ১৯৪২ সালের ৪ জুন। অর্থাৎ ৮৩ বছর পেরিয়ে ৮৪ বছর চলছে তাঁদের দাম্পত্য জীবন। বিশ্বযুদ্ধ, অবস্থানগত দূরত্ব আর সময়ের কঠিন পরীক্ষা পেরিয়ে আজও তারা একসঙ্গে আছেন।
দেখা হয়েছিল যে মুহুর্তে
একদিন ক্লার্ক আটলান্টা ইউনিভার্সিটিতে বাস্কেটবল খেলা দেখতে গিয়েছিলেন এলেনর। সময়টা ১৯৪১ সালের কোনো এক সন্ধ্যা পেরোনো ক্ষণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে খেলতে নেমেছিলেন লাইল। সেই রাতে খেলায় কে জিতেছিল, এলেনর তা বেমালুম ভুলে গেছেন। কিন্তু ভুলতে পারেননি তরুণ অ্যাথলেট লাইলের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের সেই মুহূর্ত।
অতঃপর প্রেম, প্রশিক্ষণ ও বিয়ে
খেলার মাঠে দেখা সেই মুখ কেমন এক অদ্ভুত মুগ্ধতায় গেঁথে গিয়েছিল এলেনরের বুকে। ধীরে ধীরে পরিচয়, বাড়তে থাকে যোগাযোগ। যথানিয়মে প্রেমে গড়ায় সম্পর্ক। এরই মধ্যে বিশ্বযুদ্ধে যোগদানের ডাক আসে। সেনাবাহিনীতে যোগ দেন লাইল। জর্জিয়ার সেনাঘাঁটিতে প্রশিক্ষণ শুরু হয়। অস্ত্রচালনা কিংবা নিখুঁত নিশানা নির্ণয়ের মৌলিক দক্ষতা অর্জনের উদয়াস্ত প্রশিক্ষণ চলে। কিন্তু যতটা অস্ত্রের ডগায়, তার চেয়ে বেশি এলেনরের কাছে মন পড়ে থাকে লাইলের। না, এভাবে হবে না। প্রশিক্ষণ থেকে তিন দিনের সংক্ষিপ্ত ছুটি নিয়ে লাইল আসেন এলেনরের কাছে। হাতে সময় কম। কালক্ষেপণের সুযোগ নেই। কোনো রকমে বিয়েটা সেরেই ফিরতে হবে ঘাঁটিতে। দিনটা ৪ জুন, ১৯৪২ সাল। লাইল ও এলেনর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।

যুদ্ধের দিনগুলো
বিয়ের পরপরই যুদ্ধের জন্য সেনাবাহিনীর ৯২তম পদাতিক ডিভিশনের সঙ্গে লাইলকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ইতালি। বিশ্বব্যাপী সে এক মাতাল সময়। এলেনর তখন প্রতিমুহূর্ত কাটাচ্ছেন তুমুল উৎকণ্ঠা, অনিশ্চয়তা আর অসহায়ত্বে। ইতিমধ্যে তিনি সন্তানসম্ভবা। এ সময় চলে যান নিউইয়র্ক সিটিতে। এখানেই প্রথমবারের মতো লাইলের পরিবারের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। সেখানে একটি উড়োজাহাজের যন্ত্রাংশ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে কাজ নেন। নিজের জীবন নির্বাহের পাশাপাশি লাইলের পরিবারকেও আর্থিকভাবে সহায়তা করতে থাকেন। ওয়েবসাইট গেজেটকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি একবার বলেছিলেন, লাইলকে কখনো আবার জীবিত দেখতে পাবেন, এটি তিনি ভাবতেও পারেননি। এক দিকে ভৌগোলিক দূরত্ব, অন্য দিকে যোগাযোগও সীমিত। যোগাযোগ বলতে চিঠি। তা–ও আবার অতি সংক্ষিপ্ত। উপরন্তু, সেনাবাহিনী সেসব চিঠি সেন্সর করে অধিকাংশ বক্তব্যই ঝাপসা করে দিত বা মুছে দিত। এলেনর একবার মজা করে বলেছিলেন, লাইলের চিঠিতে শব্দের চেয়ে কালো কালির আঁচড়ই থাকত বেশি। কিন্তু ভালোবাসায় মাখা সেই সংক্ষিপ্ত লাইনগুলোই তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছিল।
আবার দেখা হলো
অবশেষে যুদ্ধ শেষ হলো। ফিরে এলেন লাইল। নিউইয়র্ক সিটিতে দেখা হলো দুজনের। নতুন করে যৌথ জীবন শুরু করলেন। দুজনেই নিউইয়র্কের সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় অংশ নিয়ে উত্তীর্ণ হলেন। সরকারি চাকরিতে যোগদান করলেন। সুখী ও ব্যস্ত জীবন। তবে পেশাগত ব্যস্ততাকে তাঁরা থোড়াই কেয়ার করেছেন সব সময়। সময়-সুযোগ পেলেই দুজন মিলে বেরিয়ে পড়তেন ভ্রমণে। বিশেষ করে এলেনরের প্রিয় জায়গা ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের গুয়াদেলুপেতে বেশি যেতেন।
একসঙ্গে কত কিছু!
আদর্শ দম্পতি বলতে যা বোঝায়, ঠিক তা–ই। বয়স বাড়ছে, কিন্তু তাঁদের নতুন কিছু শেখার প্রতি অনীহা জন্মায়নি। অলস সময় কাটানোর মতো মানসিকতা তাঁদের নেই। এলেনরের যখন ৬৯ বছর বয়স, তখন তিনি আরবান এডুকেশনের ওপর ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেছেন ফোর্ডহ্যাম ইউনিভার্সিটি থেকে। দুজনেই ক্লার্ক আটলান্টা ইউনিভার্সিটির সক্রিয় সদস্য। দ্য গার্ডিয়ানের তথ্যানুসারে, তাঁরা এখন মায়ামিতে মেয়ে অ্যাঞ্জেলার সঙ্গে থাকেন।
তাহলে কি সত্যিই দীর্ঘ দাম্পত্যের কোনো গোপন সূত্র আছে? আসলে নেই—কোনো জটিল ফর্মুলা নয়, কোনো রহস্যময় কৌশল নয়। এর মূলটি খুবই সরল, নিঃশব্দ এবং শক্তিশালী—সুন্দরভাবে পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা ধরে রাখা।
লাইল গিটেনস বলেন, “আমরা একসঙ্গে সময় কাটাই। একসঙ্গে আমরা অসংখ্য কিছু করেছি।” দীর্ঘদিন একসঙ্গে থাকার পেছনে তাদের মতে কোনো রহস্য নেই, শুধু পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা, ধৈর্য এবং একসাথে থাকার ইচ্ছা।
এলেনরও একই কথা জানান, “আমরা একে অপরকে ভালোবাসি।” লাইলও পুনরায় বলে ওঠেন, “আমি আমার স্ত্রীকে ভালোবাসি।”
এই সরল, নিঃশব্দ বার্তাটিই তাদের দীর্ঘ দাম্পত্যের শক্ত ভিত্তি। বছরের পর বছর একসঙ্গে কাটানো অভিজ্ঞতা, মিলেমিশে থাকা সুখ-দুঃখের গল্প, তাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের সঙ্গে জড়িত এক অদৃশ্য কিন্তু শক্তিশালী বন্ধন—এগুলোই আমাদের শেখায় সত্যিকারের দাম্পত্যে টিকে থাকার রহস্য।
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান
এসি//