হার্ট ব্লক বা হৃদযন্ত্রের ব্লক গুরুতর একটি স্বাস্থ্য সমস্যা যা হৃদপিণ্ডের কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে হৃৎস্পন্দন বা হার্টবিট সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। হার্ট ব্লক বিশেষ করে যদি তা তৃতীয় বা চতুর্থ স্তরে পৌঁছায় তা অত্যন্ত বিপজ্জনক হতে পারে। তবে সময়মতো সনাক্তকরণ ও চিকিৎসা গ্রহণে এই সমস্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব।
হার্ট ব্লক হল একটি অবস্থা যেখানে হৃদপিণ্ডের স্বাভাবিক সংকেত প্রবাহে বিঘ্ন ঘটতে থাকে। সাধারণত হৃদপিণ্ডে সন্নিহিত সাইনাস নোডের মাধ্যমে সংকেত পাঠানো হয় যা হার্টবিট নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু যদি এই সংকেতের ট্রান্সমিশন বাধাপ্রাপ্ত হয়, তখন তা ব্লক হয়ে যায়।
হার্ট ব্লক তিনটি প্রধান স্তরে বিভক্ত করা হয়:
প্রথম স্তরের হার্ট ব্লক :
এটি হালকা প্রকারের ব্লক এবং সাধারণত কোনও বড় সমস্যা তৈরি করে না। এই অবস্থায় হৃৎস্পন্দন সামান্য ধীর হতে পারে।
দ্বিতীয় স্তরের হার্ট ব্লক :
এই অবস্থায় কিছু সংকেত হার্টে পৌঁছায় না, ফলে হৃৎস্পন্দন মাঝে মাঝে থেমে যেতে পারে।
তৃতীয় স্তরের হার্ট ব্লক (ফুল হার্ট ব্লক) :
এটি সবচেয়ে গুরুতর অবস্থা, যেখানে হার্টের সংকেত পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় এবং হৃদপিণ্ডের গতি নিয়ন্ত্রণে থাকে না। এটি জীবনসংকট তৈরি করতে পারে এবং তাড়াতাড়ি চিকিৎসা প্রয়োজন।
কারণ :
হার্ট ব্লক নানা কারণে হতে পারে। সাধারণ কারণগুলির মধ্যে রয়েছে:
• হার্টের রোগ: পূর্ববর্তী হৃদরোগ যেমন হার্ট অ্যাটাক বা আথেরোস্ক্লেরোসিস (ধমনীতে চর্বি জমা হওয়া) হার্ট ব্লকের কারণ হতে পারে।
• বয়স: বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হার্টের সিস্টেমে পরিবর্তন আসতে পারে, যার ফলে ব্লকের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।
• জন্মগত সমস্যা: কিছু মানুষের মধ্যে জন্মগতভাবে হৃদযন্ত্রের সংকেত নালীর সমস্যা থাকতে পারে।
• ড্রাগ বা ওষুধ: কিছু নির্দিষ্ট ওষুধ, বিশেষ করে হার্টের জন্য ব্যবহৃত কিছু ওষুধ যেমন বিটা-ব্লকারস বা ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকারস হার্ট ব্লকের সৃষ্টি করতে পারে।
• হাইপারটেনশন (উচ্চ রক্তচাপ): দীর্ঘ সময় ধরে উচ্চ রক্তচাপ হৃদযন্ত্রের সংকেতকে প্রভাবিত করতে পারে।
• পথ্যভ্রষ্টতা (Infections): ভাইরাসজনিত সংক্রমণ বা অন্যান্য রোগও হার্ট ব্লকের কারণ হতে পারে।
লক্ষণ :
হার্ট ব্লকের লক্ষণগুলি রোগীর স্তরের উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হতে পারে। কিছু সাধারণ লক্ষণ হল:
• হৃৎস্পন্দন ধীর বা অস্বাভাবিক হওয়া
• মন্দ লাগা বা দুর্বল অনুভূতি
• ঘাম বা অস্বস্তি
• মাথা ঘোরা বা মচকানো অনুভূতি
• বমি বমি ভাব বা ফainting
• বুকের মধ্যে ব্যথা বা চাপ
চিকিৎসা ও প্রতিরোধ :
হার্ট ব্লকের চিকিৎসা প্রতিটি রোগীর অবস্থা অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়। তবে কিছু সাধারণ চিকিৎসা পদ্ধতি আছে যা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।
ওষুধ :
প্রথমে চিকিৎসকরা হার্ট ব্লক ধীরে ধীরে নিরাময়ের জন্য ওষুধ দিতে পারেন। তবে এর প্রভাব সীমিত হতে পারে এবং দীর্ঘস্থায়ী সমাধান পাওয়া নাও যেতে পারে।
পেসমেকার ইমপ্লান্টেশন :
দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্তরের হার্ট ব্লকে পেসমেকার লাগানোর প্রয়োজন হতে পারে। এটি একটি ইলেকট্রনিক ডিভাইস, যা হার্টের স্পন্দন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে এবং সঠিকভাবে সংকেত পাঠায়।
লাইফস্টাইল পরিবর্তন :
স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের মাধ্যমে হার্ট ব্লকের ঝুঁকি কমানো সম্ভব। সুষম খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম, পর্যাপ্ত ঘুম এবং মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
অপারেশন বা সার্জারি :
কিছু ক্ষেত্রে, যদি হার্ট ব্লক খুব গুরুতর হয়ে যায়, চিকিৎসকরা সার্জারির পরামর্শ দিতে পারেন। এই চিকিৎসাটি ব্লকের কারণে সৃষ্ট অবরুদ্ধতা দূর করার জন্য করা হয়।
প্রতিরোধের উপায় :
হার্ট ব্লক প্রতিরোধের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ জীবনধারা পরিবর্তন করা যেতে পারে। যেমন:
• প্রতিদিনের ব্যায়াম: নিয়মিত ব্যায়াম হার্টের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়।
• স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: উচ্চ ফ্যাট, উচ্চ সোডিয়াম, এবং প্রক্রিয়াজাত খাদ্য এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করুন।
• রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ: উচ্চ রক্তচাপ থাকলে তা নিয়ন্ত্রণে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
• মানসিক চাপ কমানো: স্ট্রেস কমানোর জন্য নিয়মিত মেডিটেশন এবং যোগব্যায়াম সাহায্য করতে পারে।
• ধূমপান এবং মদ্যপান ত্যাগ করুন: ধূমপান এবং মদ্যপান হার্টের জন্য ক্ষতিকর।
হার্ট ব্লক গুরুতর একটি রোগ হলেও সঠিক চিকিৎসা এবং সময়মত সনাক্তকরণের মাধ্যমে এর ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব। সুতরাং, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং সচেতনতা আমাদের হৃদযন্ত্রকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করতে পারে। এক্ষেত্রে হার্ট ব্লকের লক্ষণ দেখা দিলেই দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত।
এসকে//