গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী পদ্মপুরাণ (মা মনসামঙ্গল) গানের আসরগুলো দিনদিন কালের বিবর্তনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এক সময় পদ্মপুরাণ ও কুশান গানের ব্যাপক দর্শক জনপ্রিয়তা ছিল দেশের উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীতে। গানের সঙ্গে সঙ্গে অসাধরণ নৃত্য ও সংলাপে এসেছে গদ্যছন্দে। মা মনসা ও নাগের জন্ম, দেবতার তুষ্টি, স্বামীভক্তি আর ভালোবাসার কাহিনীই হলো আবহমান বাংলার ভাসান গানের উপজীব্য।
শুক্রবার (২৫ জুলাই) রাতে লালমনিরহাট হাতিবান্ধা উপজেলার দহগ্রাম এলাকার কৈলাশ চন্দ্র রায় মূল শিল্পীসহ ১২ থেকে ১৩ জন শিল্পী পদ্মপুরাণ গান ও গীতিনাট্য পরিবেশন করেছেন। এতে প্রাচীন ঐতিহ্য মেনে পুরুষরা নারী সেজে পুরুষদের অভিনয় করছেন। হারিয়ে যাওয়া গান ও অভিনয়গুলো এক নজর দেখতে দুর-দুরান্তর থেকে আসা আত্মীয়-স্বজনসহ এলাকার শতশত নারী-পুরুষসহ শ্রোতাদর্শক ভাসান গান শুনে মুগ্ধ হয়েছে।
এ অনুষ্ঠানের বেহুলা-লখীন্দর ও শিব-পার্বতী কিশোরী মেয়েদের বর-কনে সাজিয়ে বিয়ের অসাধারণ মুহূর্তটা উপস্থিত দর্শকদের মুগ্ধ করে তোলেন। দর্শকরা যেন সত্যি সত্যি শিব পার্বতী ও বেহুলা লখীন্দরের বিয়ে দেখে অভিভুত হয়েছেন।
নাগেশ্বরী উপজেলা থেকে আসা ভাসান গানের নারী দর্শক শারতী রায় ও লালমনিরহাট থেকে আসা দর্শক শিল্পী রানী জানান, আমরা সেই উঠতি বয়সে এ পালা শুনেছিলাম। আগে গ্রামগঞ্জে অনেক দেখা যেত। এখন আর হয় না। ভাসান গানের আয়োজনে মনে হচ্ছে আবারও প্রাণ ফিরে পাচ্ছে প্রাচীন ঐতিহ্য। বহু বছর পর এখানে দেখে ভালই লাগলো।
গানের আয়োজক মনিন্দ্র চন্দ্র মন্ডল জানান, আমার মানত ছিল। তাই পাঁচদিন ব্যাপী মা মনসামঙ্গল ও পদ্মপুরাণ গানের আয়োজন করেছি। ৩৩ হাজার টাকা নিয়ে এই শিল্পী গুলো লালমনিরহাটের হাতিবান্ধা উপজেলার দহগ্রাম থেকে এসেছে। শনিবার রাতের আসর দিয়ে এগানের সমাপ্ত হবে। অনেক অনেক বছর পর এগান গুলো দেখে এলাকার হাজারো নারী-পুরুষ ও শিশু -কিশোক অনেক আনন্দ উপভোগ করছে।
ভাসান গান পরিবেশন করা পরিচালক কৈলাশ চন্দ্র রায় জানান, আমরা এই টিমটি এখানে পাঁচ দিনব্যাপী অনুষ্ঠান করছি। সৃষ্টিপত্তন (জাগানভাসান), শিব পার্বতী, বেহুলা লখীন্দর, বেহুলার বাসর ও লখীন্দের মৃত্যু পালাটির মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে।
তিনি জানান, ভাসান মূলত বেহুলা আর লখীন্দরের গীতনাট্য। সাধারণত মাঠের ফসল ওঠার পর রাত জেগে এটি পরিবেশন করা হয়। এলাকাভেদে এই গানের নাম আলাদা আলাদা। আমাদের রংপুর অঞ্চলে বিষহরি ও পদ্মপুরাণ গান নামে পরিচিত। আবার বিভিন্ন অঞ্চলে এ গানের নাম পদ্মপুরাণ গান,পদ্মার নাচন, বেহুলার নাচাড়ি, কান্দনী বিষহরির গান নামে পরিচিত।
এই শিল্পী বলেন, আগের মতো এখন এই অনুষ্ঠানগুলো যেখানে সেখানে হয় না। অনেকটা বিলীনের পথে। কিছুটা রক্ষা করছে ধর্ণাঢ্য কিছু হিন্দু পরিবার। আমি পেশার সঙ্গে ২৪ বছর আছি। কারণ এ অনুষ্ঠানগুলো অনেক ব্যয়বহুল। যার কারণে অনেকে এই অনুষ্ঠানগুলো নিতে চাই না।
অভিনয় শিল্পী কমল চন্দ্র রায়, পুষ্প চন্দ্র বর্মন, মনি শংকর রায়, অন্তর চন্দ্র বর্মন ও সুমন চন্দ্র বর্মন জানান, আগের মতো গান নেই। অনেকটা বিলুপ্তির পথে। এই পেশা দিয়ে এখন আর সংসার চলে না। এই পালাগুলো করা খুবই ব্যয় বহুল। কিছুক্ষণ পর পর পোশাক পরিবর্তন করতে হয়। আমরা প্রত্যেকেই ১০ থেকে ১৫ বছর ধরে এপেশার সঙ্গে যুক্ত। আমরা কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, দিনাজপুর ও রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় এ অনুষ্ঠান ডাক পান।

প্রধান শিক্ষক আলম মিয়া জানান, অনেক অনেক বছর আগে পদ্মপুরাণ ভাসান গান গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী গীতিনাট্যের অভিনয় দেখেছি৷ বাড়ির পাশে এই গানের আসর হওয়ায় দেখার সুযোগ হয়েছে। বিশেষ করে বর্তমান সময়ের ছেলে মেয়েদের এই গানগুলো দেখার সুযোগ হয়েছে।
গোরকমন্ডল ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য শ্যামল চন্দ্র মন্ডল জানান, ছোট বেলায় আমরা এই গানগুলো রাত জেগে শুনতাম। কাহিনীগুলো অনেক ভালই লাগতো। একটা সময় কুশানগান, পদ্মপুরাণ ভাসান গান গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী গীতিনাট্য হিসাবে পরিচিত ছিল। সারা দেশেই জনপ্রিয় এ গীতিনাট্য মানুষের মনে নির্মল আনন্দ দেওয়ার পাশাপাশি মা মনসা ও নাগের জন্ম ও পূজার প্রচলনের গল্প তুলে ধরতো।
আই/এ