রাজধানীর মোহাম্মদপুরের শাহজাহান রোডে মা লায়লা আফরোজ ও তার মেয়ে নাফিসা লাওয়াল বিনতে আজিজকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় প্রধান সন্দেহভাজন গৃহকর্মী ‘আয়েশা’র প্রকৃত পরিচয় শনাক্ত করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে গতকাল মঙ্গলবার (০৯ ডিসেম্বর) রাত পর্যন্ত তাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।
পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, অভিযুক্ত তরুণীর প্রকৃত নাম ও তার স্বামীর পরিচয় নিশ্চিত করা গেছে। তবে গ্রেপ্তারের পরই তা আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদেই এই নৃশংস জোড়া হত্যাকাণ্ডের কারণ জানা যেতে পারে। বাসায় ঢুকে মা-মেয়ের নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পুলিশও হতবাক। মরদেহের সুরতহাল ও আঘাতের ধরন দেখে তদন্তকারীরা ধারণা করছেন, ঘাতক সম্ভবত বাইরে থেকেই পরিকল্পিতভাবে এই অস্ত্র সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। অস্ত্রের ধরন এবং ব্যবহারের কায়দা দেখে পুলিশের ধারণা, ঘাতক প্রশিক্ষিত অথবা সে মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত (সাইকোপ্যাথ) হয়ে অতিরিক্ত ক্ষোভ থেকে এমন কাণ্ড ঘটিয়েছে।
পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, ঘটনাস্থল থেকে দুটি ছুরি উদ্ধার করা হয়েছে। এর একটি সাধারণ সবজি কাটার ছুরি হলেও অন্যটি একটি বিশেষ ধরনের ‘সুইচ গিয়ার’। এটি আঙুলের মধ্যে এমনভাবে আটকে ব্যবহার করা হয়, যাতে আঘাতের সময় হাত থেকে ফসকে না যায়। এই ধরনের অস্ত্র সচরাচর বাসাবাড়িতে ব্যবহার করা হয় না।
তদন্তে জানা গেছে, হত্যাকাণ্ডের পর ঘাতক অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় বাথরুমে প্রবেশ করে। সেখানে সে গোসল করে এবং নিজের রক্তমাখা পোশাক পরিবর্তন করে নিহত মেয়ের স্কুল ড্রেস পরে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। এই ঘটনায় কথিত গৃহকর্মী আয়েশাকে আসামি করে মোহাম্মদপুর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে।
তেজগাঁও বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার ইবনে মিজান জানান, হত্যার ধরন ও নৃশংসতা দেখে প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে ঘাতক প্রশিক্ষিত হতে পারে।
তিনি বলেন, আমরা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করছি। হত্যার আগে ও পরে সন্দেহভাজনের উপস্থিতি ও কার্যক্রম খতিয়ে দেখা হচ্ছে। যেহেতু ঘাতক মেয়ের স্কুল ড্রেস পরে পালিয়েছে এবং বিশেষ অস্ত্র ব্যবহার করেছে, তাই এটি পরিকল্পিত হতে পারে।
পুলিশ আশা করছে, পলাতক গৃহকর্মীকে গ্রেপ্তার করা গেলেই এই নৃশংস জোড়া খুনের নেপথ্যের আসল রহস্য উদঘাটন করা সম্ভব হবে।
উল্লেখ্য, সোমবার (০৮ ডিসেম্বর) সকালে শাহজাহান রোডের ওই ভবনের সপ্তম তলায় লায়লা আফরোজ (৪৮) ও তার মেয়ে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী নাফিসা লাওয়াল বিনতে আজিয়াকে (১৫) ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। পরিবারের অভিযোগ চার দিন আগে ‘আয়েশা’ নামে কাজ নেওয়া ২০–২২ বছর বয়সী ওই তরুণীই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। ঘটনার পর থেকে সে পলাতক রয়েছে।
এজাহার অনুযায়ী, খুনের পর বাসা থেকে মোবাইল ফোন, একটি ল্যাপটপ, স্বর্ণালংকার ও নগদ টাকা লুট হয়েছে।
ভবনের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, হত্যাকাণ্ডের পর আয়েশা নাফিসার স্কুলড্রেস পরে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে সকাল ৯টা ৩৫ মিনিটে বাসা থেকে বেরিয়ে যান। তিনি সকাল ৭টা ৫১ মিনিটে কাজে ঢুকেছিলেন।
সব সময় বোরকা পরে থাকায় তার মুখ স্পষ্টভাবে ধরা না পড়ায় শনাক্তে পুলিশকে ম্যানুয়ালি কাজ করতে হয়েছে। আশপাশের সিসিটিভি ক্যামেরাগুলো নিস্ক্রিয় থাকায় তার পালানোর পথও পরিষ্কারভাবে জানা যায়নি।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ওই তরুণীর দেওয়া নাম–ঠিকানা ভুয়া ছিল। বাসা থেকে নেওয়া মোবাইল ফোনটিও বাড়ির গেট ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করে দেন তিনি। পরিবারের সঙ্গেও তার কোনো ফোনালাপ ছিল না।
হত্যাকাণ্ডের পর নিহত লায়লা আফরোজের স্বামী স্কুলশিক্ষক আ জ ম আজিজুল ইসলাম মোহাম্মদপুর থানায় গৃহকর্মী ‘আয়েশা’কে একমাত্র আসামি করে হত্যা মামলা করেন।
তিনি জানান, সোমবার সকালে তিনি স্কুলে চলে যাওয়ার পর স্ত্রীর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। বাসায় ফিরে দেখেন স্ত্রী ও মেয়ের রক্তাক্ত লাশ।
সুরতহাল প্রতিবেদন অনুযায়ী, লায়লা আফরোজের শরীরে প্রায় ৩০টি ছুরিকাঘাত ছিল। মেয়ের শরীরে ছিল ৬টি ছুরিকাঘাত।
ময়নাতদন্ত শেষে গতকাল তাদের মরদেহ নাটোর পৌরসভার দক্ষিণ বড়গাছায় দাফন করা হয়েছে।
মোহাম্মদপুর থানার ওসি মেজবাহ উদ্দিন বলেন, হত্যার মোটিভ এখনো পরিষ্কার নয়। অভিযুক্ত গৃহকর্মীকে গ্রেপ্তারে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে।
এসি//