ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের বিশ্ববিখ্যাত ল্যুভর মিউজিয়ামে ঘটে গেছে চাঞ্চল্যকর এক চুরির ঘটনা। রোববার(১৯ অক্টোবর) সকালে জাদুঘর খোলার কিছুক্ষণ পরই তিন জন মুখোশধারী অনুপ্রবেশকারী অ্যাপোলো গ্যালারিতে ঢুকে নেপোলিয়ন যুগের আটটি মূল্যবান রত্নালংকার চুরি করে নিয়ে যায়। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কর্তৃপক্ষ সারাদিনের জন্য জাদুঘরটি বন্ধ করে দেয়।
সোমবার (২০ অক্টোবর) লুটের এ ঘটনা নিয়ে বিস্তারিত এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আল জাজিরা।
প্রতিবেদনে জানা যায়, লুটেরাদের ধরতে রোববার সারাদিন ব্যাপি প্যারিসজুড়ে অভিযান চালিয়েছে স্থানীয় পুলিশ। এখনও ল্যুভর মিউজিয়ামটিকে ঘিরে রেখেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।চোরের দল এত দ্রুত ও দক্ষতার সঙ্গে চুরির কাজ সেরেছে যে অনেকের কাছে এটিকে ঠিক হলিউডের কোন সিনেমার গল্প মনে হয়েছে।
ফ্রান্স সরকার ও জাদুঘর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, অনুপ্রবেশকারীরা আসবাব তোলার একটি মই ব্যবহার করে জানালা ভেঙে গ্যালারিতে প্রবেশ করে। মাত্র চার মিনিটের মধ্যেই তারা জাদুঘরের ভেতর থেকে রত্নালংকারগুলো নিয়ে মোটরসাইকেল যোগে পালিয়ে যায়। যাওয়ার পথে তারা অবশ্য আরেকটি মূল্যবান অলংকার ফেলে রেখে গেছে। এই ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ইমান্যুয়েল ম্যাঁক্রো।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্টে তিনি লিখেছেন, যে ঐতিহ্যকে নিয়ে আমরা গর্বিত হই, এটি তার ওপর একটি আক্রমণ।
অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন ম্যাঁক্রো।
তিনি বলেন, ‘এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্যারিস প্রসিকিউটর দপ্তরের নেতৃত্বে সকল জায়গায় সবকিছুই করা হচ্ছে।’
যা যা নিয়ে গেলো লুটেরারা
সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে রোববার(১৯ অক্টোবর) সন্ধ্যায় নিশ্চিত করে বলা হয়, লুটেরারা দুইটি উচ্চ-নিরাপত্তাযুক্ত প্রদর্শনী কেস থেকে মোট আটটি বহুমূল্য রত্নালংকার চুরি করে নিয়ে যেতে সফল হয়েছে।
চুরি যাওয়া বস্তুগুলোর মধ্যে ছিলো-ফরাসি সম্রাট প্রথম নেপোলিয়নের স্ত্রী সম্রাজ্ঞী মেরি-লুইজের ব্যবহৃত কয়েকটি অলংকার, বাকি মূল্যবান বস্তুগুলো ছিলো নেপোলিয়ন তৃতীয়ের স্ত্রী সম্রাজ্ঞী উজিনির।
চুরি যাওয়া অলংকারগুলো হলো-সম্রাজ্ঞী মেরি-অ্যামেলি এবং সম্রাজ্ঞী হরটেন্সের অলংকার সেটের টিয়ারা এবং নীলমণি বসানো কণ্ঠহার। নীলমণি বসানো একটি অলংকার সেটের একটি কানের দুল, রানি মেরি-লুইজের অলংকার সেটের পান্না বসানো কণ্ঠহার, তাঁর পান্না বসানো এক জোড়া কানের দুল, ‘রিলিকোয়ারি’ নামে পরিচিত একটি মহামূল্যবান ব্রোচ এবং সম্রাজ্ঞী উজিনির টিয়ারা ও বড় একটি ব্রোচ।
তবে, জাদুঘরের বাইরের দেয়ালের কাছে পড়ে থাকা অবস্থায় পাওয়া গেছে সম্রাজ্ঞী উজিনির মুকুট। খুব সম্ভবত পালিয়ে যাওয়ার সময় ভুলবশত চোরের দলটি সেটি ফেলে রেখে যায়। সেটিতে ১ হাজার ৩৫৪টি হীরা ও ৫৬টি পান্না রয়েছে। চুরির সময় সেটির ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে জাদুঘর কর্তৃপক্ষ।
মূল্যবান শিল্পকর্ম চুরি বিশেষজ্ঞ অ্যান্থনি আমোরে আল-জাজিরাকে বলেন, ‘এসব বস্তু শুধু অর্থের দিক দিয়েই মূল্যবান নয়, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দিক থেকেও অমূল্য।’
অ্যান্থনি আমোরে আরও বলেন, ‘এটি কোনো মাস্টারপিস চুরির মতো নয়, যেখানে সংবাদমাধ্যম সঙ্গে সঙ্গে সেটির ছবিটি প্রকাশ করবে। এ ধরনের বস্তুগুলো হয়তো টুকরা টুকরা করে ভেঙে ফেলা হবে এবং তারপর পৃথক রত্ন হিসেবে বিক্রি করা হবে। সাধারণ মানুষের পক্ষে সেগুলো চেনাও সম্ভব হবে না।’
যেভাবে চুরির মিশন সফল করল চোরেরা
ল্যুভর মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ বলেছে, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, মোটরসাইকেল ও দারুণ দক্ষতার মিশেলে চোরের দল দুর্ধর্ষ এই চুরির মিশনে সফল হয়েছে।
পুলিশের একটি সূত্র বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছে, চোরের দলটি অ্যাঙ্গেল গ্রাইন্ডার নিয়ে একটি স্কুটারে চড়ে ল্যুভর জাদুঘর প্রাঙ্গণে উপস্থিত হয়। চোরেরা ভাঁজ করা যায় এমন একটি মই ব্যবহার করে বাইরের দিকে থেকে গ্যালারিতে ঢোকে এবং ডিস্ক কাটার দিয়ে জানালার কাচ কেটে ভেতরে প্রবেশ করে।
সংস্কৃতিমন্ত্রী রাশিদা দাতি বলেন, ‘চুরির তথ্য পাওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে কর্তৃপক্ষ সেখানে উপস্থিত হয়। সত্যি বলতে, মাত্র চার মিনিটের মধ্যে চোরের দল এই কাজ করেছে। সবকিছু হয়েছিল খুবই দ্রুত।’
তিনি আরও বলেন, ‘চোরেরা পেশাদার ছিলেন। আজকাল সংঘবদ্ধ অপরাধীরা শিল্পকর্মকে নিশানা বানাচ্ছে এবং জাদুঘরগুলো অবশ্যই তাদের লক্ষ্যে পরিণত হচ্ছে।’
চুরির পর ঘটনাস্থলের একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, জাদুঘর ভবনের সামনের দিকে একটি ভাঁজ করা মই দাঁড়িয়ে আছে। মইটি যেখানে রাখা, সেখান দিয়েই চোরের দল ভবনে প্রবেশ করেছিল বলে ধারণা করা হয়।
এর আগেও ল্যুভরে সাড়া জাগানো একটি চুরির ঘটনা ঘটেছিল। ১৯১১ সালে জাদুঘরটি থেকে ‘মোনালিসা’ চিত্রকর্ম লোপাট করা হয়।দুই বছর পর ১৯১৩ সালে ইতালির একটি হোটেল থেকে সেটি উদ্ধার হয়। পরে আবার মোনালিসাকে ল্যুভরে ফিরিয়ে আনা হয়।