চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র মামুন মিয়া। পরিবার ভেবেছিল, কয়েক মাস পরই পড়াশোনা শেষ করে হয়তো কর্মজীবনে প্রবেশ করবে, ঘুরে দাঁড়াবে সংসারের হাল ধরতে। কিন্তু এক রাতের সহিংসতা সবকিছু ওলটপালট করে দিয়েছে।
শনিবার (৩০ আগস্ট) রাতের সেই সংঘর্ষে রামদার আঘাতে মামুনের মাথা ক্ষতবিক্ষত হয়। আঘাত এত গভীর যে, ডাক্তারদের তার খুলির একটি অংশ কেটে ফ্রিজে সংরক্ষণ করতে হয়েছে। মাথায় শক্ত ব্যান্ডেজ, তার ওপর লেখা সতর্কবার্তা “হাড় নেই, চাপ দেবেন না।” যেন প্রতিটি শব্দ পরিবারটির বুকের ভেতর নতুন করে কষ্ট খোদাই করে দিচ্ছে।
মামুনের বড় ভাই মাসুদ রানা, যিনি টাঙ্গাইলে শিক্ষকতা করেন, ভাইয়ের শয্যার পাশে বসে বারবার ভেঙে পড়ছেন। তার চোখ ভিজে আছে নিরাশার অশ্রুতে। তিনি বললেন, “মামুন কথা বলতে পারছে, কিন্তু ও আগের মতো স্বাভাবিক হবে কিনা আমরা জানি না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় যে স্বপ্ন দেখেছিলাম, সেটা হয়তো আজ ভেঙে যাচ্ছে। চিকিৎসকরা বলেছেন সুস্থ হতে দীর্ঘ সময় লাগবে, আর ভবিষ্যতে অনেক সীমাবদ্ধতা মানতে হবে।”
শুধু মামুন নয়, একই সংঘর্ষে গুরুতর আহত হয়েছেন অর্থনীতি বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র ইমতিয়াজ আহমেদ সায়েম। আহত বন্ধুদের হাসপাতালে নিতে গিয়ে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে মাথায় গুরুতর ক্ষত পান তিনি। জরুরি অস্ত্রোপচারের পর চার দিন পেরোলেও তিনি চোখ মেলেননি। এখনো পার্কভিউ হাসপাতালের আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে আছেন সায়েম।

করিডোরে বসে দিন-রাত কাটাচ্ছেন তার বাবা মোহাম্মদ আমির হোসেন। ছেলের শয্যার বাইরে দাঁড়িয়ে কণ্ঠ ভারী করে বললেন, “অনেকবার নিষেধ করেছিলাম, মারামারির কাছে যাস না। কিন্তু সে বলেছিল, আহত বন্ধুদের হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। তারপর খবর পেলাম, আমার ছেলেকে কুপিয়ে রক্তাক্ত করা হয়েছে। মানুষ এভাবে কীভাবে আরেকজনকে কোপাতে পারে!”
পার্কভিউ হাসপাতালের স্পেশালাইজড ইউনিটের প্রধান চিকিৎসক ডা. সিরাজুল মোস্তফা জানালেন, “সায়েমের মাথায় গভীর আঘাত লেগেছে, খুলির ভেতরের অংশ ও রক্তনালী মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। রক্তচাপে সামান্য উন্নতি হলেও তার অবস্থা এখনও শঙ্কাজনক।”
তিনি আরও জানান, “মামুনের অবস্থা কিছুটা ভালো। তার খুলি ফ্রিজে রাখা আছে। সবকিছু ঠিক থাকলে দুই থেকে আড়াই মাস পরে পুনঃস্থাপন করা হবে। তবে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে সময় লাগবে।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেট এলাকায় এই ভয়াবহ পরিস্থিতির সূচনা হয়েছিল। এক ছাত্রী দেরি করে ভাড়া বাসায় ফিরতে চাইলে দারোয়ান তার ওপর হাত তোলেন। শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদে নামেন আর মুহূর্তেই তা গ্রামবাসীর সঙ্গে সংঘর্ষে রূপ নেয়। রক্তক্ষয়ী এই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ও প্রক্টরসহ প্রায় ৪০০ জন আহত হন। এর মধ্যে তিন শিক্ষার্থী এখনো জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে লড়ছে।
এসকে//