৩ ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁও হানাদার মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এইদিনে ঠাকুরগাঁও মহকুমা প্রথম শত্রুমুক্ত হয়। তৎকালীন সময়ে ঠাকুরগাঁও ছিল উত্তরের প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি মহকুমা। বর্তমানে ঠাকুরগাঁও এবং পঞ্চগড় জেলার ১০টি থানা ছিল এই মহকুমার অন্তর্গত। হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ঠাকুরগাঁওবাসী গড়ে তুলেছিলো দুর্বার প্রতিরোধ।
এই প্রতিরোধের কারণেই ১৯৭১ সালে ১৪ই এপ্রিল পর্যন্ত হানাদার বাহিনী প্রবেশ করতে পারেনি ঠাকুরগাঁওয়ের মাটিতে। ১৫ই এপ্রিল ১০টি ট্রাক ও ৮টি জিপে করে মুহুর্মুহু সেল বাজিয়ে ও গুলি বর্ষণ করতে করতে ঠাকুরগাঁও শহরে ঢুকে পড়ে পাক হানাদার বাহিনীর সদস্যরা। তবে তেঁতুলিয়া থানাকে কেন্দ্র করে ১৫০ বর্গমাইলের ১টি মুক্তাঞ্চল গড়ে উঠে। সেখানে পাকবাহিনীর সদস্যরা কখনও ঢুকতে পারেনি মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধের মুখে। সেখান থেকেই পরিচালিত হয় চুড়ান্ত লড়াই। ঠাকুরগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধ নতুন শক্তিতে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। নানা কৌশলে আক্রমণ করা হয় শত্রুর ওপর। কখনও সম্মুখ যুদ্ধ আবার কখনও গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে শত্রুদের পরাস্ত করা হয়।
ঠাকুরগাঁও ছিল ৬ নম্বর সেক্টরের অন্তর্ভূক্ত। কমান্ডার ছিলেন বিমান বাহিনীর স্কোয়াড্রন লিডার এম খাদেমুল বাশার। এ সেক্টরে প্রায় ১০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা ছিল। সমগ্র সেক্টরে ১২০ টির মত গেরিলা বেইজ গড়ে তোলা হয়। ৮ মে পর্যন্ত সুবেদার কাজিমউদ্দীন অধিনায়কের দায়িত্বে ছিলেন। ৯ মে ক্যাপ্টেন নজরুল কাজিমউদ্দীনের কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নেন। জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে স্কোয়াড্রন লিডার সদরুদ্দীন এবং ১৭ জুলাই ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার সাব সেক্টরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
মুক্তিবাহিনীর বীর যোদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়ে পাক হানাদারেরা। পাক বাহিনীর সদস্যরা ব্রীজ, কালর্ভাট, রেললাইন, পাওয়ার স্টেশন উড়িয়ে দিলেও অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধারা মনোবল হারান নি। বরং তারা সাহসের সাথে যুদ্ধ করে গেছেন। অন্যদিকে পাক হানাদাররা ছাড়াও দালাল ও রাজাকারদের ওপর শাস্তিমূলক আক্রমণ পরিচালনা করা হয় দফায় দফায়।
১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর এ মহকুমার পঞ্চগড় থানা প্রথম শত্রু মুক্ত হয়। পঞ্চগড় হাত ছাড়া হওয়ার পর পাকবাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে গেলে তারা পিছু হটে ময়দানদীঘি, বোদা, ভূলী হয়ে ঠাকুরগাঁওয়ে ঘাঁটি স্থাপন করে। ভারতীয় মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ আক্রমণ চলতে থাকে পাক বাহিনীর
ঠাকুরগাঁওয়ে স্থাপিত ক্যাম্পগুলোর উপর। সে সময়ে পাক সেনারা ৩০ নভেম্বর ভূলী ব্রীজ উড়িয়ে দেয়। তারা সালন্দর এলাকার সর্বত্র বিশেষ করে আখক্ষেতে মাইন পেতে রাখে। মিত্রবাহিনী তাৎক্ষণিকভাবে ভূলী ব্রীজ মেরামত করে ট্যাঙ্ক পারাপারের ব্যবস্থা করে। ১ ডিসেম্বর ভূলী ব্রীজ পার হলেও মিত্র বাহিনী যত্রতত্র মাইনের কারণে ঠাকুরগাঁও শহরে ঢুকতে বিলম্ব হয়।
ঐসময় শত্রুদের মাইনে মিত্র বাহিনীর দুটি ট্যাংক ধ্বংস হয়। পরে কমান্ডার মাহাবুব আলমের নেতৃত্বে মাইন অপসারণ করে মিত্রবাহিনী ঠাকুরগাঁও শহরের দিকে অগ্রসর হয়। ২ ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁওয়ে চলে শেষ যুদ্ধ। এ দিন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর একটি সমন্বিত দলের সাথে পাক বাহিনীর প্রচন্ড গোলাগুলি হয় সারা রাত। মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর সাহসী আক্রমনে ভীত হয়ে শেষ রাতে শত্রু বাহিনী ঠাকুরগাঁও থেকে পিছু হটে ২৫ মাইল নামক স্থানে অবস্থান নেয়। ৩ ডিসেম্বর ভোর রাতে ঠাকুরগাঁও শহর হয় শত্রুমুক্ত হয়।
দিবসটি উপলক্ষে আগামীকাল বুধবার নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে হানাদারমুক্ত দিবস পালন করার কথা রয়েছে।
আই/এ