ছাত্র-জনতার গণবিস্ফোরণের মুখে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ত্যাগ করেন। ওইদিন দুপুর আড়াইটার দিকে একটি সামরিক হেলিকপ্টারে তিনি গণভবন ত্যাগ করে ভারতের উদ্দেশে রওনা দেন। তার সঙ্গে ছিলেন ছোট বোন শেখ রেহানা।
হাসিনার দেশত্যাগের কয়েক ঘণ্টা আগে ঢাকা থেকে দিল্লিতে যায় দুটি গুরুত্বপূর্ণ ফোন কল। সেই কথোপকথনের তথ্য প্রকাশ করেছে বিবিসি বাংলা।
মঙ্গলবার (০৫ আগস্ট) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বিবিসি জানায়, সেদিন বেলা ১২টার কিছু পর পরপর দুটি ফোন যায় দিল্লিতে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর পরে দেশটির পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে ফোনালাপের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
প্রথম ফোনটা এসেছিল খোদ শেখ হাসিনার কার্যালয় থেকে, কথা বলেছিলেন বাংলাদেশের হাসিনা নিজেই। জয়শংকর অবশ্য বলেননি কার কাছে ফোন করেছিলেন, তবে প্রোটোকল বলে এই ধরনের পরিস্থিতিতে সাধারণত দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যেই কথা হয়ে থাকে।
ভারত ততক্ষণে জেনে গেছে, দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রী হাসিনা পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। এরপরই দিল্লিতে টেলিফোন করে তিনি অনুরোধ করেন, তাকে ‘তখনকার মতো’ ভারতে আসার অনুমোদন দেওয়া হোক। সেই অনুরোধে সঙ্গে সঙ্গেই ইতিবাচক সাড়া দেয়া হয়।
দ্বিতীয় ফোনটা আসে একটু পরেই, বাংলাদেশের বিমানবাহিনীর কাছ থেকে দিল্লিতে ভারতের এয়ারফোর্স কমান্ডের কাছে। শেখ হাসিনাকে বহনকারী সামরিক বিমান যাতে ভারতের নির্দিষ্ট কোনও বিমানঘাঁটিতে অবতরণ করার অনুমতি পায়, আনুষ্ঠানিকভাবে সেই ‘ক্লিয়ারেন্স’ চেয়ে করা হয় এই দ্বিতীয় ফোনটা। সেই অনুমতিও দেয়া হয় সঙ্গে সঙ্গেই। এই দ্বিতীয় ফোনটার অবশ্য একটা বিশেষ ‘পটভূমি’ বা ‘ব্যাকগ্রাউন্ড’ আছে।
এদিকে, শেখ হাসিনাকে ভারতে আসার আনুষ্ঠানিক অনুমতি দেয়া হলেও সেটি একেবারেই ‘সাময়িক’ বলে ধারণা ছিল। কিন্তু ৫ অগাস্ট বিকেল থেকেই দিল্লি প্রবল জল্পনায় সরগরম ছিল, শেখ হাসিনা শেষ পর্যন্ত ভারত থেকে কোন দেশে পাড়ি দিচ্ছেন! ব্রিটেন তো তালিকায় ছিলই, সঙ্গে নরওয়ে বা সুইডেনের মতো কোনও স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ বা এমনকি বেলারুশের কথাও শোনা যাচ্ছিল।
অথচ, শেখ হাসিনা তখনও বাংলাদেশের ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্টধারী, সঙ্গী বোন শেখ রেহানাও যুক্তরাজ্যের দ্বৈত নাগরিক। ফলে ৫ অগাস্ট রাতেই দিল্লি থেকে তারা অনায়াসে লন্ডনের উদ্দেশে রওনা হয়ে যাবেন, ভারত সরকার প্রথমে এমনটাই ভেবেছিল। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার সেই পরিকল্পনায় বাদ সাধে। দিল্লিতে নিযুক্ত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে নতুন প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ের স্টার্মারের সরকার ভারতকে জানিয়ে দেয়, শেখ হাসিনাকে এখনই তারা সেদেশে আসতে দিতে পারছে না।
অথচ তারা আসলে তৃতীয় কোনও দেশে যাচ্ছেন, এই ভাবনাতেই বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর সিজে-১৩০ এয়ারক্র্যাফটকে সে রাতে হিন্ডন বিমানঘাঁটিতেই থেকে যেতে বলা হয়েছিল – সেটিকে ঢাকাতে ফিরতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু সেটা যে খুব শিগগিরি ঘটছে না, এটা পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার পর মঙ্গলবার (৬ অগাস্ট) সকাল ১০টা নাগাদ বিমানটি আবার ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়ে যায়।
লক্ষণীয় যে, গত কয়েক মাসে একাধিকবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়ালের কাছে শেখ হাসিনার অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন করা হলে, তিনি প্রতিবারই জানিয়েছেন—ভারতে তার অবস্থান ‘সাময়িক’।
ভারতের সরকারি অবস্থান এখনো স্পষ্ট- শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেয়া হয়েছে কেবল তখনকার পরিস্থিতিতে তার সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য। অর্থাৎ, “for the moment”—এই ভাষায়ই বিষয়টি তুলে ধরেছে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
এসি//