দেবী দুর্গার বাহনে লুকিয়ে আছে বছরের ভাগ্য
শারদীয় দুর্গোৎসবের প্রতিটি মুহূর্ত যেন ভক্তদের জন্য এক রহস্যময় খেলা—ঢাকের ঝংকার, বাতাসে ভেসে আসা ঘ্রাণ, মণ্ডপে আলো আর ছায়ার খেলা সব মিলিয়ে তৈরি করে এক অদ্ভুত আভা। তবে উৎসবের এই আনন্দ ও উচ্ছ্বাসের মাঝেও লুকিয়ে আছে আধ্যাত্মিক ও শাস্ত্রীয় বার্তা। দেবী দুর্গার আগমন ও গমন শুধু আনুষ্ঠানিকতার অংশ নয়; এটি প্রকৃতি ও মানুষের জীবনের সম্ভাব্য পরিবর্তনের সূক্ষ্ম ইঙ্গিত বহন করে।
হিন্দুশাস্ত্র ও পুরাণমতে, প্রতিবার দেবীর আগমন ও গমন নির্ধারিত হয় তার বাহনের উপর—গজ, ঘোটক, নৌকা বা দোলা। আর সেই বাহনেই লুকিয়ে থাকে বছরের ভাগ্য, প্রকৃতির চিত্র এবং সমাজজীবনের সূক্ষ্ম আভাস। ভক্তদের জন্য এই আগমন ও গমন কেবল দর্শনীয় নয়, বরং তা ভাবনার বিষয়, কারণ প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি বাহন, প্রকৃতির নিঃশব্দ বার্তাকে চোখে আঙ্গুলে ধরিয়ে দেয়।
দেবীর বাহন ও তার তাৎপর্য
সাধারণত দেবী চার প্রকার বাহনে আগমন ও গমন করেন—গজ (হাতি), ঘোটক (ঘোড়া), নৌকা এবং দোলা (পালকি)। প্রতিটি বাহনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভিন্ন ভিন্ন বার্তা, যা কখনো শুভফল, কখনো আবার অশুভের ইঙ্গিত বহন করে।
গজ (হাতি): হাতিতে আগমন বা গমন সর্বাধিক শুভ ধরা হয়। এর অর্থ প্রকৃতি শস্যপূর্ণ হবে, কৃষিজমি ভরে উঠবে ফসলে, মানুষ পাবে সমৃদ্ধির আভাস। হাতি শক্তি ও শান্তির প্রতীকও বটে।
ঘোটক (ঘোড়া): ঘোড়ায় আসা বা যাওয়া মানেই অস্থিরতা, ধ্বংস আর বিপর্যয়ের বার্তা। শাস্ত্রমতে, এটি যুদ্ধ, অরাজকতা বা ছত্রভঙ্গ পরিস্থিতির ইঙ্গিত বহন করে।
নৌকা: নৌকায় আগমন বা গমন জলপ্রবাহ ও বন্যার প্রতীক। তবে এটি একেবারে অশুভ নয়। বন্যা যেমন দুর্যোগ ডেকে আনে, তেমনি পলি জমে উর্বর জমির ইঙ্গিত দেয়, যা ভবিষ্যতে ভালো ফসল ফলায়। তাই নৌকার আগমন/গমন মিশ্র প্রতীক বহন করে।
দোলা (পালকি): পালকিতে আগমন বা গমন সাধারণত অশুভ। শাস্ত্রে বলা হয়, এর ফলে মহামারী বা মড়কতুল্য বিপদের আশঙ্কা তৈরি হয়। দোলা মানেই দুঃখ ও রোগ-ব্যাধির ছায়া।

বার নির্ভর শুভ-অশুভ
দেবীর বাহন নির্ধারিত হয় কোন বার সপ্তমী ও দশমী পড়ছে তার ওপর। যেমন—
সপ্তমী বা দশমী রবিবার/সোমবার → গজে আগমন বা গমন
মঙ্গলবার/শনিবার → ঘোটকে আগমন বা গমন
বুধবার → নৌকায় আগমন বা গমন
বৃহস্পতিবার/শুক্রবার → দোলায় আগমন বা গমন
একই বাহনে আগমন ও গমন হলে তা অশুভ ধরা হয়।
২০২৫ সালের ভবিষ্যদ্বাণী
শাস্ত্রমতে, ২০২৫ সালে দেবী দুর্গার আগমন ঘটছে গজে (হাতি)—যা শুভ লক্ষণ। এর ফলে ভালো ফসল ও প্রাচুর্যের ইঙ্গিত মিলছে। তবে দেবীর গমন হবে দোলায় (পালকি), যা মহামারী বা রোগব্যাধির শঙ্কার প্রতীক। অর্থাৎ, এই বছর একদিকে যেমন প্রকৃতি সমৃদ্ধির আভাস দিচ্ছে, অন্যদিকে মানুষের জীবনযাত্রায় ভোগান্তির সম্ভাবনাও উঁকি দিচ্ছে।

বাহন-আধ্যাত্মিক প্রতীক
দেবী দুর্গার বাহন কেবল প্রকৃতির ভবিষ্যদ্বাণী নয়, বরং মানুষের মনোজগতের প্রতীকও।
হাতি মানে ধৈর্য, স্থিরতা ও শুভ্রতা।
ঘোড়া বোঝায় অস্থিরতা ও আক্রমণাত্মক প্রবৃত্তি।
নৌকা জীবনের ভেসে চলা ও অনিশ্চয়তার প্রতীক।
দোলা বোঝায় ভোগান্তি, ক্লান্তি ও রোগব্যাধির ভয়।
প্রতিবার দেবীর আগমন–গমন ভক্তদের মনে যেমন আনন্দ ও কৌতূহল জাগায়, তেমনি বার্তা দেয় জীবনের শুভ–অশুভ দ্বন্দ্বের। ২০২৫ সালে মর্ত্যে দেবীর আগমন শুভ হলেও বিদায় ইঙ্গিত দিচ্ছে সতর্কতার। প্রকৃতির আশীর্বাদে শস্যপূর্ণ হবে ভুবন, কিন্তু ভক্তদের প্রার্থনা থাকবে যেন দোলার অশুভ বার্তা বাস্তবে রূপ না নেয়।
এসি//