বিনোদন

বুয়েট ছেড়ে ঝুঁকেছিলেন অভিনয়ে, এক যুগ ধরে নিভৃত জীবন কাটাচ্ছেন বৈরাগী

ছবি: সংগৃহীত

চলচ্চিত্র ও টেলিভিশনের জনপ্রিয় মুখ ছিলেন তিনি। আশির দশকে যার উপস্থিতি মানেই ছিল দর্শকের ভালোবাসায় সিক্ত হওয়া, সেই অভিনেতা ফখরুল হাসান বৈরাগী এখন আর আলো ঝলমলে শোবিজ দুনিয়ার অংশ নন। সময়ের স্রোতে বয়সের ভারে তিনি এখন অনেকটাই নুয়ে পড়েছেন।

প্রায় এক যুগ ধরে নিজেকে রেখেছেন পর্দার আড়ালে। তবে এই আড়ালে থাকা কোনো অভিমান বা তিক্ততা থেকে নয়- পুরোটাই ছিল স্বেচ্ছায় গুটিয়ে নেওয়া।

অনেক বছর পর অবশেষে তার খোঁজ মিলেছে।

ঢাকার পাশের কেরানীগঞ্জের আঁটিবাজার এলাকার একটি হাউজিং সোসাইটির ৯তলা ভবনের ৪র্থ তলায় এখন কাটছে তার নিরিবিলি দিনগুলো। সন্তানদের সঙ্গেই রয়েছেন তিনি। 

অভিনয়ের প্রতি ছিল একধরনের উন্মাদনা—প্রচণ্ড টান। সেই ভালোবাসার টানেই ফখরুল হাসান বৈরাগী ছেড়ে দেন বুয়েটের পড়াশোনা, দ্বিতীয় বর্ষেই ড্রপ-আউট হয়ে যান। তারপর নিজেকে পুরোপুরি সঁপে দেন অভিনয় জগতের আলো-ছায়ায়। এই শোবিজ অঙ্গনে টানা কাজ করেছেন প্রায় ৫০ বছর, রেখে গেছেন অগণিত দর্শকপ্রিয় কাজ।

তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বয়স বাড়েছে, শরীরের ক্লান্তিও। তাই প্রায় ১২ বছর আগে তিনি নিজ থেকেই আলোর জগত থেকে সরে যান। কোনো অভিমান নয়—একান্ত নিজের ইচ্ছায়, চুপিচুপি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন নীরব এক অবসরে।

“একদিন এক সুন্দর সকালে মনে হলো—এই জীবন আর চাই না,”

এই কথাটা বলে যেন নিজের দীর্ঘ অভিনয়জীবনের ওপর এক নিঃশব্দ পর্দা টেনে দিলেন আশির দশকের জনপ্রিয় অভিনেতা ও নির্মাতা ফখরুল হাসান বৈরাগী।

চলচ্চিত্র থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন প্রায় ১২ বছর হলো। এখন আর কোনো শুটিং, লাইট-ক্যামেরা কিংবা সেটের ব্যস্ততা নেই। নেই কোনো মিডিয়ার আনাগোনা। তিনি এখন থাকেন ঢাকার পাশের কেরানীগঞ্জের আঁটিবাজার এলাকায়, সন্তান ও নাতিদের সঙ্গেই কেটে যাচ্ছে সময়।

নিজেই জানালেন, এই আড়ালে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল একান্তই তার। বললেন, “আমি যে এই পেশায় এসেছি, তা কেউ বলেনি। ভালো লেগেছে বলেই এসেছি। আর এখন ইচ্ছা করেই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি। কারও কাছ থেকে বিদায় নিতে হয়নি।”

এই বয়সে কেমন আছেন বৈরাগী?

প্রশ্নের উত্তরে হালকা হাসির সুরে বললেন—"আমার বয়স অনুযায়ী ভালোই আছি। তবে হাঁটুতে জোর নেই, চলাফেরায় কষ্ট হয়। মাথা ঘোরে মাঝেমধ্যে, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি। ২৫ বছর ধরে ডায়াবেটিস আছে—এসব নিয়েই বেঁচে আছি।”

তার দিন কাটে খুব সাধারণভাবে। ইউটিউবে মাঝে মাঝে নাটক দেখেন, টেলিভিশনে খবর রাখেন—এই পর্যন্তই।

২০১৩ সাল থেকেই ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। বলেন, “আগের দিনগুলো এখন আর মনে পড়ে না। মনে পড়ুক চাইও না। যে কাজটা ভালো লেগেছে, সেটাই করেছি। যখন মনে হয়েছে অনেক হয়েছে, তখন ছেড়ে দিয়েছি।”

বর্ষীয়ান অভিনেতা ফখরুল হাসান বৈরাগীর কণ্ঠে এখন শুধুই জীবনচর্চার উপলব্ধি। সময়, বয়স, আলো আর অন্ধকারের ভেতর দিয়ে হেঁটে আসা মানুষটি জানেন—শেষ সময়টা কেমন হতে পারে।

তিনি বলেন, “একটা বয়স এলে মানুষের চেহারার আলো কমে, শক্তি ফুরায়, মন বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। তখন অনেকেই ভাবেন—এই সমাজে, এই পৃথিবীতে আমার আর কোনো জায়গা নেই। এই ভয়টাই সবচেয়ে বেশি। তাই আমি চাই, সেই ভয় আসার আগেই মনকে গড়ে তুলতে হবে, যাতে বিষণ্ণতা কখনও কাবু করতে না পারে।”

অভিনয়ের চেনাজানা পথে কাটিয়েছেন পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময়। তবুও তার চোখে নেই কোনো অভিমান, নেই কোনো অভিযোগ। শুধু একটাই চাওয়া—যখন যাবার সময় হবে, সেটা যেন হয় শান্তিতে।

“জানি, চলে যেতে হবে একদিন। হয়তো খুব বেশি দেরিও নেই। তাই চাই, শেষ ক’টা দিন যেন কেটে যায় শান্তভাবে। বিদায়টা যেন হয় নির্ঝঞ্ঝাট, নির্ভার। আর এর জন্যই সবার দোয়া চাই।”

ফখরুল হাসান বৈরাগীর জন্ম ১৯৫০ সালে। তিনি অসংখ্য নাটক ও চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। কি যে করি (১৯৭৬), রাজিয়া সুলতানা (১৯৮৪), প্রেম যুদ্ধ (১৯৯৪) চলচ্চিত্রে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। সূর্য দীঘল বাড়ী (১৯৭৯), সুরুজ মিয়া (১৯৮৪), দহন (১৯৮৫) এবং মরণের পরে (১৯৯০) এর মত চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। ১৯৮৫ সালে ‘নাদিরা’ নামে তার পরিচালিত একটি চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। এর বাইরে তাকে ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’-এর বিভিন্ন চরিত্রে বহুবার দেখা গেছে। 

ক্যারিয়ার হিসেবে অভিনয়কে বেছে নিলেও এর পাশাপাশি পরিচালক এবং প্রযোজক হিসেবেও সফল ছিলেন ফখরুল হাসান বৈরাগী। তার উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে বিনি সুতার মালা, মানসী, শাহী দরবার, স্বামীর ঘর, লুটেরার মতো ব্যবসা সফল হিট সিনেমা।

২০১৬ সালের আগস্টে অভিনেতা ফখরুল হাসান বৈরাগী টানা ৪০ দিনেরও বেশি সময় নিখোঁজ ছিলেন। ওই সময় তাঁর স্ত্রী রাজিয়া হাসান থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। পরে অবশ্য বৈরাগী নিজেই বাড়িতে ফিরে আসেন।

 

এসি//

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন